টেকনোলজি
তথ্য কিভাবে সংরক্ষণ করা যায়? আধুনিক ও নিরাপদ ডাটা সংরক্ষণের ১০টি সেরা উপায়
তথ্য কিভাবে সংরক্ষণ করা যায়? আধুনিক ও নিরাপদ ডাটা সংরক্ষণের ১০টি সেরা উপায়
আপনার কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভটি হঠাৎ ক্র্যাশ করল। কিংবা ফোনটি হাত থেকে পড়ে ডিসপ্লে ভেঙে গেল, আর অন হচ্ছে না। মনের ভেতর কেমন অনুভূতি হবে একবার ভাবুন তো? বছরের পর বছর জমানো ছবি, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস, কিংবা নিজের লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপি—সব এক নিমেষে শেষ।
ভয়ংকর, তাই না?
আসলে তথ্য বা ডাটা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে দামী সম্পদ। একে বলা হয় ‘নিউ অয়েল’। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা তথ্য তৈরির পেছনে যতটা সময় দিই, তা সংরক্ষণের বা ব্যাকআপ রাখার ব্যাপারে ঠিক ততটাই উদাসীন। “আমার সাথে এমনটা হবে না” এই ভুল ধারণা থেকেই বড় বড় ডিজিটাল বিপর্যয় ঘটে।
আজকের ব্লগে আমরা জানব তথ্য কিভাবে সংরক্ষণ করা যায়, কেন এটি এত জরুরি এবং ১০টি এমন উপায় যা আপনার ডিজিটাল জীবনকে নিরাপদ রাখবে। একদম সহজ ভাষায়, প্রফেশনাল টিপস সহ। চলুন শুরু করি।
তথ্য সংরক্ষণ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
সোজা কথায়, ডিজিটাল ডিভাইস নশ্বর। যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র যেকোনো সময় নষ্ট হতে পারে। হার্ড ড্রাইভের একটা গড় আয়ু আছে, ক্লাউড অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড হ্যাক হতে পারে, এমনকি ভাইরাসের আক্রমণেও ফাইল নষ্ট হতে পারে।
তথ্য সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হলো ‘রিডানডেন্সি’ বা বিকল্প ব্যবস্থা রাখা। যাতে মূল সোর্স নষ্ট হলেও আপনার কাছে কপি থাকে। ব্যবসার ক্ষেত্রে ডাটা লস মানে টাকার ক্ষতি, আর ব্যক্তিগত জীবনে এর মানে হলো স্মৃতি হারিয়ে ফেলা। তাই সঠিক নিয়মে তথ্য সংরক্ষণ করা এখন আর কোনো অপশন নয়, এটি অত্যাবশ্যকীয়।
তথ্য সংরক্ষণের ১০টি কার্যকরী উপায়
তথ্য সংরক্ষণের পদ্ধতিগুলোকে আমরা মূলত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি: ফিজিক্যাল বা হার্ডওয়্যার ভিত্তিক এবং অনলাইন বা ক্লাউড ভিত্তিক। তবে সেরা ফলাফল পেতে হাইব্রিড পদ্ধতি ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিচে ১০টি উপায় বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. ক্লাউড স্টোরেজ (Cloud Storage)
সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সহজ পদ্ধতি। গুগল ড্রাইভ (Google Drive), ড্রপবক্স (Dropbox), বা ওয়ানড্রাইভের (OneDrive) মতো সার্ভিসগুলো ব্যবহার করে আপনি নিমিষেই ফাইল ইন্টারনেটে সেভ করে রাখতে পারেন।
সুবিধা:
- যেকোনো জায়গা থেকে অ্যাক্সেস করা যায়।
- ডিভাইস হারিয়ে গেলেও তথ্য ঠিক থাকে।
- অটোমেটিক সিঙ্ক অপশন থাকে।
টিপস: শুধুমাত্র ফ্রি স্পেসের ওপর নির্ভর করবেন না। প্রফেশনাল কাজের জন্য পেইড প্ল্যান কেনা বুদ্ধিমানের কাজ। আর অবশ্যই টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (2FA) চালু রাখবেন।
২. এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ (HDD)
কম্পিউটারের ভেতরের স্টোরেজ ফুল? অথবা ব্যাকআপ দরকার? একটা ভালো মানের এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ কিনে নিন। ১ বা ২ টেরাবাইটের ড্রাইভগুলো এখন বেশ সস্তা।
এটি প্লাগ-এন্ড-প্লে। অর্থাৎ ইউএসবি পোর্টে লাগাবেন, আর ফাইল ট্রান্সফার করবেন। ইন্টারনেট সংযোগের প্রয়োজন নেই, তাই হ্যাকিংয়ের ভয়ও কম থাকে যদি না আপনি ফিজিক্যালি ড্রাইভটি হারিয়ে ফেলেন।
৩. সলিড স্টেট ড্রাইভ (SSD)
আগের দিনের হার্ড ড্রাইভের চেয়ে এসএসডি (SSD) অনেক বেশি ফাস্ট এবং টেকসই। কারণ এতে কোনো মুভিং পার্টস বা ঘুরন্ত চাকতি নেই। হাত থেকে পড়ে গেলেও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি সাধারণ হার্ড ড্রাইভের চেয়ে অনেক কম।
যাদের ভিডিও এডিটিং বা ভারী ফাইল নিয়ে কাজ করতে হয়, তাদের জন্য পোর্টেবল এসএসডি সেরা অপশন। দাম একটু বেশি, কিন্তু তথ্যের নিরাপত্তার কথা ভাবলে এটি পয়সা উসুল ইনভেস্টমেন্ট।
৪. ইউএসবি ফ্ল্যাশ ড্রাইভ (Pen Drive)
ছোটখাটো ফাইল, যেমন—অফিসের প্রেজেন্টেশন বা কিছু ছবি এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে নেয়ার জন্য পেন ড্রাইভের জুরি নেই। এটি পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়।
তবে সাবধান! পেন ড্রাইভ খুব সহজেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। তাই দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য এটি একমাত্র মাধ্যম হওয়া উচিত নয়। এটি কেবল সাময়িক ট্রান্সফার বা দ্বিতীয় ব্যাকআপ হিসেবে ব্যবহার করুন।
৫. নেটওয়ার্ক অ্যাটাচড স্টোরেজ (NAS)
এটি একটু প্রফেশনাল লেভেলের সলিউশন। সহজ ভাষায়, এটি আপনার নিজের তৈরি একটি ছোটখাটো ‘পার্সোনাল ক্লাউড’। NAS ডিভাইসটি আপনার বাসার বা অফিসের ওয়াইফাই রাউটারের সাথে যুক্ত থাকে।
এর ভেতরে একাধিক হার্ড ড্রাইভ থাকে। আপনি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যেকোনো ডিভাইস থেকে এতে তথ্য রাখতে বা নিতে পারবেন। ছোট অফিস বা যারা প্রচুর মিডিয়া ফাইল (মুভি, গান) সংরক্ষণ করেন, তাদের জন্য এটি আদর্শ।
৬. অপটিক্যাল ডিস্ক (CD/DVD/Blu-ray)
অনেকে বলবেন, “সিডি-ডিভিডির যুগ তো শেষ!”। কথা সত্য, কিন্তু তথ্যের ‘ কোল্ড স্টোরেজ’ বা আর্কাইভ করার জন্য এটি এখনো চমৎকার।
হার্ড ড্রাইভ বা এসএসডি অনেক দিন বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়া পড়ে থাকলে ডাটা করাপ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু একটা ভালো মানের ডিভিডি বা ব্লু-রে ডিস্কে রাইট করা ডাটা অন্ধকারে যত্ন করে রাখলে ১০-২০ বছর অনায়াসেই টিকে থাকে। ভাইরাস সংক্রমণের কোনো সুযোগই নেই এখানে।
৭. ইমেইল আর্কাইভ
ছোটোখাটো ডকুমেন্ট বা নোটস সংরক্ষণের জন্য নিজের ইমেইলটিই হতে পারে সেরা ভল্ট। গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো নিজেকেই ইমেইল করে রাখুন। সাবজেক্ট লাইনে সঠিক কিওয়ার্ড ব্যবহার করুন যাতে পরে সার্চ দিয়ে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। গুগল বা ইয়াহুর সার্ভার আপনার হার্ড ড্রাইভের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।
৮. মেমোরি কার্ড (SD Cards)
ফটোগ্রাফার বা কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য এটি লাইফলাইন। ক্যামেরা বা ড্রোন থেকে ফুটেজ নেয়ার পর ভালো মানের এসডি কার্ডে সংরক্ষণ করা যায়। তবে এগুলো খুব নাজুক হয়। তাই বিশেষ কেস বা বক্সে রাখা জরুরি।
৯. ফিজিক্যাল ডকুমেন্ট বা হার্ডকপি
সবকিছুই ডিজিটাল করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আপনার জমির দলিল, সার্টিফিকেট, বা চুক্তিনামার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের স্ক্যান কপি যেমন কম্পিউটারে রাখবেন, তেমনি এর ফটোকপি বা প্রিন্ট আউট লেমিনেট করে ফাইলবন্দী করে রাখাও এক ধরণের তথ্য সংরক্ষণ। ডিজিটাল সিস্টেম ফেইল করলে এই কাগজই আপনাকে বাঁচাবে।
১০. ৩-২-১ ব্যাকআপ মেথড (সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল)
এটি কোনো যন্ত্র নয়, এটি একটি নিয়ম। তথ্য সংরক্ষণের স্বর্ণালি সূত্র বলা হয় একে। নিয়মটি হলো:
- ৩টি কপি: আপনার তথ্যের অন্তত তিনটি কপি থাকতে হবে।
- ২টি মাধ্যম: এই কপিগুলো অন্তত দুটি ভিন্ন ধরণের ডিভাইসে রাখতে হবে (যেমন: একটি ল্যাপটপে, অন্যটি এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভে)।
- ১টি অফসাইট: অন্তত একটি কপি আপনার মূল অবস্থানের বাইরে রাখতে হবে (যেমন: ক্লাউডে বা অন্য কোনো বাসায়)।
তথ্য সংরক্ষণে যে ভুলগুলো আমরা প্রায়ই করি
শুধু স্টোরেজ কিনলেই হবে না, ব্যবহারের নিয়মও জানতে হবে। নিচে কিছু কমন ভুলের কথা উল্লেখ করছি:
ব্যাকআপ চেক না করা: আপনি নিয়মিত ব্যাকআপ নিচ্ছেন, কিন্তু ফাইলগুলো আসলে ওপেন হচ্ছে কিনা তা চেক করছেন না। বিপদের সময় দেখলেন ফাইল করাপ্টেড। তাই মাঝে মাঝে রিস্টোর করে চেক করুন।
একই ফোল্ডারে সব রাখা: অর্গানাইজেশন বা বিন্যাস খুব জরুরি। তারিখ বা প্রজেক্ট অনুযায়ী ফোল্ডার না করলে দরকারের সময় ফাইল খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো হবে।
এনক্রিপশন ব্যবহার না করা: সেনসিটিভ ডাটা (যেমন ব্যাংকের তথ্য) পোর্টেবল ড্রাইভে রাখলে অবশ্যই পাসওয়ার্ড প্রোটেকশন বা এনক্রিপশন ব্যবহার করুন। ড্রাইভ হারিয়ে গেলেও কেউ আপনার তথ্য পড়তে পারবে না।
ডাটা রিকভারি: শেষ ভরসা
এত সতর্কতার পরেও যদি তথ্য হারিয়ে যায়? তখন ডাটা রিকভারি সফটওয়্যার বা প্রফেশনাল সার্ভিসের সাহায্য নেওয়া লাগে। এটি বেশ ব্যয়বহুল এবং সবসময় ১০০% তথ্য ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি থাকে না। তাই “প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম”—এই প্রবাদটি মেনে চলুন।
শেষ কথা
তথ্য সংরক্ষণ বা ব্যাকআপ রাখা অনেকটা ইনস্যুরেন্সের মতো। যতদিন বিপদ না আসে, মনে হয় অযথা খরচ বা ঝামেলা। কিন্তু যেদিন হার্ড ড্রাইভ ক্র্যাশ করে, সেদিন মনে হয় এর চেয়ে জরুরি আর কিছু ছিল না।
আজই একটু সময় বের করুন। আপনার ফোন এবং ল্যাপটপের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো চেক করুন। উপরের ১০টি উপায়ের মধ্যে অন্তত দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে আপনার মূল্যবান স্মৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। মনে রাখবেন, একবার হারিয়ে যাওয়া ডিজিটাল তথ্য ফিরে পাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আপনার তথ্য সুরক্ষিত থাকুক, আপনিও নিশ্চিন্ত থাকুন।